শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মাচারীঃ----
  সংক্ষিপ্ত জীবনী ও বন্দনা
 

শ্রী শ্রী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর

(সংক্ষিপ্ত জীবনী ও বন্দনা) 


 নবিংশ শতকের বাংলা তথা ভারতের এক গৌরবজ্জ্বল অধ্যায় এই শতকে বাংলাদেশে একদিকে যেমন এসেছেন ভক্ত,জ্ঞানী,যোগী তেমনি অপরদিকে এসেছেন দেশপ্রেমিক,বৈজ্ঞানিক,কবি ও সাহিত্যিক ।

              বর্ত্তমান পশ্চিমবাংলার অন্তর্গত ২৪ পরগনা জেলার কচুয়া গ্রামে (বাংলা ১১৩৭ সালে) (যদিও জন্মস্থান সম্পর্ক মতভেদ থাকতে পারে)র্ধামিকশ্রেষ্ঠ শ্রীরামনারায়ণ ঘোষাল ও কমলা দেবীর পরিবারের চতুর্থ সন্তান হিসাবে জন্মগ্রহন করেন । উনবিংশ শতকের যোগীশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী । পিতা রামনারায়ণ চন্দ্রের ইছ্ছা তাঁর চার পুত্রের মধ্যে এক পুত্র সন্ন্যাসধর্ম্ম গ্রহন করে এবং ব্রক্ষজ্ঞান লাভ করে । কারণ শাস্ত্রে কথিত আছে যদি বংশে কেউ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে তবে সেই বংশের সদ্ গতি এবং মুক্তি হয় । শিশু লোকনাথ জন্মগ্রহণের পূর্ব্বে মাতা কমলাদেবীর ইছ্ছানুসারেই পিতা রামনারায়ণ তিন পুত্রের কাহাকেও সন্ন্যাস দিবার বাসনা কার্যে রুপায়িত করিতে পারেন নাই । কারণ মাতা কমলাদেবী কোন সন্তানকেই নিজের কোল হইতে বিদায় দিয়া গৃহত্যাগী করিয়া সন্ন্যাসী করিয়া দিতে সম্নত হন নাই । শিশু দিন দিন বারিতে লাগিল । শুভদিনে অন্নপ্রাশন সম্পন্ন হইল এবং নামকরন হইল লোকনাথ । ভক্তজ্ঞানী পিতার পুত্রের নাম করণেই দুরদশিতার পরিচয় । যে শিশু ভবিষ্যতে পৃথিবীর মানুষের মুক্তির পথ দেখাইবে,যাহার দয়ায়,করুণায় মানুষ জীবনে অমৃতের স্বাদ গ্রহণ করিতে সমর্থ হইবে তিনি তো  সকলের নাথ তাই লোকনাথ ছাড়া আর উপযুক্ত নাম কই?                          ক্রমে শিশু হাটিতে শিখিল । খেলিতে হইবে, সঙ্গি কোথায়? সঙ্গী জুটিল এক বালিকা। কিন্তু খেলিবে কি?  উপযুক্ত বালকের উপযুক্ত খেলা পূজা-পূজা, ধ্যান-ধ্যান খেলা শুরু হইল । বালিকা খেলার ছলে ফুল সংগ্রহ করে । আর খেলার ছলে ধ্যানে নিমগ্ন হয় ক্রমে তাঁহার চোখ হয় পলকহিন, দেহ হইয়া ওঠে ঋজু,শ্বাস প্রশ্বাস স্তব্ধ,এই ভাবাবেশ দেখে  বালিকা ভয় পায় । পিতা রামনারয়ণ একদিন এই দৃশ্য দেখিয়া মনের বাসনায় পূর্ণতার ইঙ্গিত পাইয়া আকুল হইয়া উঠিলেন ।   ছুটিলেন গ্রামের পন্ডিতশ্রেষ্ঠ সর্ব্বশাস্ত্রজ্ঞ মহাজ্ঞানী মহাজন ভগবান চন্দ্র গাঙ্গুলীর নিকট উপযুক্ত গুরুর উপযুক্ত শিষ্যকে তুলিয়া দিবার ব্যবস্তা করিতে । ভগবান গাঙ্গুলি জ্ঞ্যনের পুজারী, বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে সবকিছু জানবার প্রবণতা,তিনি জ্ঞানযোগী । তিনি গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী না হলেও অনাসক্ত মনোভাব সম্পন্ন,সংসারে থেকেও নেই ।

কালক্রমে লোকনাথের অপর এক খেলার সঙ্গি জুটিয়ে গেল ঐ গ্রামেরই ছেলে,তাঁহারই সমবয়সী বেনিমাধব ।  শুভদিন উপস্থিত,বালক লোকনাথের শুভ উপনয়ন,সন্ন্যাস গ্রহণের শুভলগ্ন । বালক বেনীমাধব বন্ধুর সন্ন্যাস গ্রহণের সংবাদে পুলকিত হয়ে উঠল । অভি ভাবকদের জানাল নিজ মনের অভিলাষের কথা । সেও গ্রহন করবে সন্ন্যাস । পিতা মাতা আত্নীয় স্বজন সকলে বেনীমাধবকে এই দুরাহ সংকল্প হইতে চ্যুত করিবার চেষ্টা করিলেন কিন্তু সক্ষম হইলেন না ।

উপনয়নের শুভদিন উপস্থিত । আত্নীয়ের ভিড়ে মুখরিত উৎসব গৃহ ।মাতা কমলা শত আনন্দ ও উৎসাহের মধ্যেও মনে হয় বুকটা যেন একেবারে থালি ।

এবার লোকনাথের অভিষেক । সন্ন্যাস নেবার শুভক্ষণে যাত্রা শুরু । সকলের আগে চললেন লোকনাথ,মাঝখানে বাল্য সুহাদ সঙ্গী বেণীমাধব,পিছনে গুরু ভগবান গাঙ্গুলী। পেছনে পেছনে চললেন মাতা কমলাদেবী, পিতা রামনারায়ন ও অগণিত গ্রামবাসী এই সন্ন্যাসী বালকদের গ্রামের সীমান্তে বিদায় দিতে । দুই কিশোর শির্ষ্যসহ গুরু ভগবান গাঙ্গুলী গৌরীপুর,মধ্যমগ্রাম,পাঁতিপুকুর,
কলিকাতা,অতিক্রম
করে উপস্থিত হলেন কালিঘাটে । তারা উপস্থিত হলেন হিন্দুদের পবিত্র তীর্থস্থান কালিঘাটে। যাত্রীরা ক্লান্তির নিঃশ্বাস ত্যাগের পর আশ্রয় নিলেন যাত্রীশালার ঘড়ে বিশ্রামের প্রয়োজনের তাগিদে ।

তীর্থক্ষেত্রে সর্বস্থানের সর্ব্বশ্রেণীর মানুষের মিলন । বালক লোকনাথ সাধু সন্তানদের দেখে মজা অনুভব করেন । সাধু সন্ন্যাসীরা এই বালকের জ্বলায় অতিষ্ট হয়ে গুরু ভগবানের নিকট নালিশ করলেন-ভগবান শিষ্যদের বোঝালেন জিবনে মানুষ যে রকম ব্যবহার করে তাকেও ঠিক সেইরুপ ব্যবহারই পেতে হয় । অন্যকে দুঃখ দিলে ; সুখ দিলে বিনিময়ে সুখ পাওয়া যাবে । আর তাছাড়া ভবিষ্যতে লোকনাথকেও সাধুদের মত লেংটি পড়ে জীবন কাটাতে হবে ।

 

লোকনাথের মনে বিস্ময় জাগে । গুরু তার কর্ত্তব্য করে শিষ্যের মনের সমস্যার,সমাধান করে ।ভগবান বোঝালেন সন্ন্যাস জীবনের চিত্র কিন্তু জ্ঞানী বালকের জিজ্ঞাসার শেষ নাই । বালকের প্রত্যেক যুক্তিই বয়স্কজনোচিত । গুরু বুঝলেন এই বালকের ভবিষ্যৎ সফলতার কথা ।

 

আবার পথ ধরে চললেন অভিযাত্রী ।পথের বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে নদীনালা পার হয়ে অমূল্য বস্তর সন্ধানে । তুছ্ছ করে মানুষের পরম কাম্য কাম,কামিনী,কাঞ্চন,সুখ ভোগ,প্রতিষ্ঠা । আহারে বিহারে স্বাছ্ছন্দ্যকে করেছেন প্রত্যাহার ।মায়ামমতা করে এসেছেন পদদলিত । এই ভাবে দীর্ঘ বার বৎসর অতিক্রম হওয়ার পর গুরু ভগবান গাঙ্গুলী শিষ্যদ্বয় সহ আবার জন্মভুমিতে প্রত্যাবর্ত্তন করেন । এই সময়ে হঠাৎ যুবক লোকনাথের সহিত ঐ গ্রামের এক ব্রাহ্মণ বাল্য বিধবার প্রণয় হয় । দিনের পর দিন অতিবাহিত হয় । লোকনাথের মন ক্রমশঃ বিষময় হইতে শুরু করে কিন্তু ভগবান গাঙ্গুলী আরো কিছুদিন অপেক্ষা করার কথা বলেন । ক্রমশঃ তাঁহার মন হইতে নারী জাতির প্রতি সহজাত আকর্ষন লুপ্ত হয় আর তখন ঐ প্রণয়িনীর আকর্ষণ অনুভব করে না । লোকনাথ গুরুর এই আচরণে ক্ষুদ্ব হইয়া চেলা কাঠ দিয়া গুরুকে মারিতে উদ্যত হয় ।  ভগবান গাঙ্গুলী এই দিনটির আশায়ই বসিয়াছিলেন । তিনি শিষ্যকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন,’এবার তোর পাপা মুক্ত হইয়াছে—এবার তুই চল’।

 

গুরু শিষ্যদ্বয়কে নিয়ে আসেন লোকালয় হইতে দুরে হিমালয়ের কোলে । নিজে ভিক্ষা করে স্বয়ং রান্না করেন মাতার মতন,সেবা করেন শিষ্যদ্বয়ের । হঠাৎ একদিন লোকনাথ গুরুদেবকে বিদ্যাশিক্ষা দানের জন্য অনুরোধ করেন ।

 

উত্তরে ভগবান শিষ্যদ্বয়কে জানান যে তাঁহার যত জ্ঞান সঞ্চিত আছে তাহা আস্তে আস্তে কালক্রমে তাহার শিষ্যদের মধ্যে সংক্রামিত হইবে । গুরু শিষ্যদিগকে কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করাইবার উদ্দেশ্যে পর্য্যায়ক্রমে নন্ক্তব্রত,একান্তরা,ত্রিরাত্র পকাহ ও ক্রমে নবরাত্র ও দ্বাবদাহ ও সর্ব্বোপরি মাসাহ ব্রত পালন করাইলেন।

 

নক্তব্রতে ব্রহ্মচারীগনকে দিবাভাগে উপবাসী থাকিয়া রাত্রে যৎসামান্য আহার করিতে হয় এবং মাসাহ ব্রতে এক মাসকাল পালনের কালে গুরু ভগবান গাঙ্গুলী শিষ্যদিগকে কোনরুপে অঙ্গ সঞ্চালন করিতে দিতেন না । কঠোর মাসাহ ব্রত লোকনাথ দুইবার পালন করেন কিন্তু বেণীমাধব এই ব্রত পালনে অক্ষম হন । সমস্ত ব্রতানুষ্ঠান সমাপ্ত হওয়ার পর লোকনাথ নিজের উরুর উপর পায়েস রন্ধন করিয়া গুরুদেবকে ভোগ দিয়া ব্রহ্মচর্য্যের পরীক্ষা দেন ।

এরপর ভগবান শিষ্যদ্ধয়কে হটযোগ শিক্ষা দেন চন্দ্র ও সূর্য্যের মিলনই হইল হটযোগ ।

 

তখন লোকনাথের সমাধি-এমন ছিল যে দেহেতে জল জমে বরফ হয়ে আবার কখন গলিয়া যাইত তাহা টেরও পাইত না ।

এই অবস্থায় একদিন লোকনাথ গুরুর চরনে পতিত হইয়া কাঁদিয়া আকুল হইলেন যে গুরুর দৌলতে শিষ্য যে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করিয়াছে গুরুর এখনও তাহা হয় নাই ।

 

এর দীর্ঘদিন পরে বাবা লোকনাথ ডেঙ্গু কর্ম্মকারের সহিত বারদী গ্রামে আসিয়া আশ্রম স্থাপন করেন । ক্রমে ক্রমে ডেঙ্গু কর্ম্মকারের অবস্থা ফিরিয়া যায় । প্রথম প্রথম এই যোগীকে সকলে উপহাস করিত । কিন্তু ঘটনা পরম্পরায় এই মহান যোগীর অলৌকিক কার্য্যাবলী লক্ষিত হওয়ার পর সারা গ্রামে তাঁহার গুণমুগ্ধ শি্য্য ও ভক্তের সংখ্যা স্ফীত হইয়া উঠিল ।

 

১৬০ বৎসর বয়সে এই মহাজ্ঞানী তপস্বী যোগী দীনজনের  পক্ষে বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী বারদী গ্রামে দেহরক্ষা করেন ।   


 

 
  Today, there have been 1 visitors (2 hits) on this page!  
 
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free